বাংলাদেশে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ :প্রধানমন্ত্রী
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ডিজিটাল জগতে বাংলাদেশে সবাইকে সুরক্ষিত রাখতেই এই আইন। ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন গড়েছি, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা দেওয়াও আমাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্বটাও আমাদের পালন করতে হবে।’
তিনি গতকাল শনিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার সুখবর জানাতে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকেন প্রধানমন্ত্রী। ভার্চুয়াল এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে এবং সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তাঁকে প্রশ্ন করার সুযোগ পান সাংবাদিকরা। আলজাজিরার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে প্রতিবেদন, উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছার নানা তথ্য, করোনাকালে এ দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারের সাফল্য, কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন এ দেশে আনতে পারার সাফল্যসহ নানা বিষয়ে কথা হয়।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুর দিকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চান এক সাংবাদিক। প্রধানমন্ত্রী জবাবে বলেন, ‘শিশু থেকে শুরু করে, যুবক থেকে শুরু করে কেউ যেন বিপথে যেতে না পারে বা কোনো অসামাজিক কার্যকলাপ অথবা কোনো ধরনের জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত হতে না পারে, এমন কোনো কাজ যেন না করে যেটা দেশের জন্য ক্ষতি হয়, দেশের মানুষের জন্য ক্ষতি হয়, সে জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা দেওয়া একান্তভাবে অপরিহার্য।’
এই আইনের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমালোচনা যারা করেছে, তারা করবেই। কারা সব থেকে বেশি সমালোচনা করছে? তারা কি বাস্তব কথাটা একবার উপলব্ধি করছে? তারা তো তা করছে না। আমার বয়স ৭৫ বছর। স্কুলজীবন থেকে রাস্তায় নামি। বাষট্টি সাল থেকে পথে পথে মিছিলে মিছিলে যোগ দিয়েছি। কাজেই এ দেশের সবাইকে আমার চেনা আছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার মারা যান। তাঁর নাম উল্লেখ না করলেও ইঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, কারো মৃত্যু কাম্য নয়। কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি করাও কাম্য নয়।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে রকম ঘটনা তো আর ঘটেনি। যারা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, তাদের সাথেও তো অনেকেই গাঁটছাড়া বেঁধেছিল। তবে কারো মৃত্যু কাম্য নয়। কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেলে কী করার আছে।’
পরে আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের যে অভিযোগ উঠেছে, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সতর্কবার্তা থাকবে কি না। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইন তো আপন গতিতে চলে। আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। কোনটা আপনার কাছে অপপ্রয়োগ, কোনটা অপপ্রয়োগ না,
এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কিন্তু আমি তো মনে করি, আইন নিজের গতিতে চলছে এবং চলবে। যদি কেউ অপরাধ না করে তার বিচারে শাস্তি হবে না। কিন্তু আদৌ অপরাধ হচ্ছে কি না, কিংবা এমন কোনো কাজ করছে কি না, যেটা দেশের ক্ষতি হচ্ছে, জনগণের ক্ষতি হচ্ছে, সে কাজ থেকে বিরত করার জন্যই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট।’
কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আলজাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কোনো প্রতিক্রিয়াও নাই, কিছু বলারও নাই। একটা চ্যানেলে কী বলছে না বলছে, সেটা দেশের মানুষ বিচার করবে। কতটুকু মিথ্যা, কতটা বানোয়াট, তারা বিচার করবে।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারের কথা তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাদের বিচার হয়েছে, তারা, তাদের পরিবার কি চুপ করে বসে থাকবে? তাদেরও কিছু ইন্ধন আছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অদ্ভুত কিছু মিথস্ক্রিয়া দেখা যায়। আল্ট্রা লেফট-আল্ট্রা রাইট মাঝেমধ্যে এক হয়ে যায়!’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা চায় নাই, যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, যারা গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে, আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে, যারা এই দেশটাকে অস্ত্র চোরাকারবারি, ড্রাগ চোরাকারবারি, দুর্নীতির একটা আখড়ায় পরিণত করেছে, তারা বাংলাদেশের উন্নতিটা মানবে কিভাবে বলেন?
তারা বদনাম করার চেষ্টা করছে। কোন চ্যানেল কী বলল না বলল, সেটা শুনে তো আমার রাজনীতি না। দেশের মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম, সেটাই আমার রাজনীতি। যারা বলতে থাকছে, বলতে থাকুক। বলতে থাকাই তো তাদের কাজ।’
এর আগে লিখিত বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে প্রায় এক বছর পর আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। তবু সরাসরি নয়; ভার্চুয়ালি। আজ অবশ্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি বাংলাদেশের একটি মহৎ এবং গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশ গতকাল স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে।
আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি। সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের। আমাদের এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটল, যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি; আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে টেনে তুলে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে তাঁরই হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করল।’
তিনি বলেন, ‘ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর আমি ব্যাপকভাবে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা সফর করি। আমি সে সময়ই প্রতিজ্ঞা করি, যদি কোনো দিন আল্লাহ আমাকে সুযোগ দেন দেশ পরিচালনার, তাহলে গ্রামোন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। গ্রামের মানুষের উন্নয়নে কিছু করব। তখন ৭০-৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত। আমার মনে হয়েছিল, এদের যদি দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকের ভিত্তিতে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের তিনটি মানদণ্ড খুব ভালোভাবে পূরণ করে।
তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ পুনরায় সকল মানদণ্ড অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পূরণের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করল।’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের পর্যালোচনায় ২০১৯ সালে মাথাপিছু আয়ের মানদণ্ড নির্ধারিত ছিল এক হাজার ২২২ মার্কিন ডলার। ওই বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৮২৭ ডলার। আর বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার।
অর্থাৎ মানদণ্ডের প্রায় ১.৭ গুণ। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদণ্ড ৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫.৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে উত্তরণের জন্য মানদণ্ড নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। কিন্তু ওই সময়ে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৭।’
তিনি বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে। আমাদের এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এটি একটি বিশেষ ধাপ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। আর্থিক এবং অন্য সূচকগুলোর দিকে লক্ষ করুন। ২০০৮-০৯ বছরে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ সালে তা ৩৩০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই ১২ বছরে সরকারি ব্যয় ৪.৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭ হাজার ৯৬০ কোটি থেকে ২০১৯-২০ বছরে চার লাখ ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা হয়েছে।
২০০৮-০৯ বছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ বছরে তা ৪০.৫৪ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ বছরের ৭.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪.০৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০১ সালে আমাদের দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ এবং হতদারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০.৫ ভাগ এবং হতদারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশে।’